পর্যটন স্পট উন্মুক্ত : কক্সবাজারে বাড়ছে করোনা

বিশেষ প্রতিবেদক •

স্বাস্থ্যবিধিসহ প্রশাসনের নির্দেশনা যথাযথভাবে না মানায় কক্সবাজারে হোটেল-মোটেল কর্মচারী আর পর্যটন কর্মিদের মধ্যে করোনা সংক্রমণের হার বেড়েই চলছে।

এতে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ার পাশপাশি কক্সবাজার আবারো নতুন করে হট স্পটে পরিণত হওয়ার আশংকা করছেন বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিস্টরা।

করোনা পরিস্থিতির কারণে গত মধ্য মার্চ থেকে দীর্ঘ ৫ মাসেরও বেশী সময় ধরে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতসহ পর্যটন কেন্দ্রগুলো বন্ধ ছিল। এ নিয়ে পর্যটকদের আনাগোনা একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। তবে করোনা পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক না হলেও স্থানীয় নানা মহলের দাবির প্রেক্ষিতে স্বাস্থ্যবিধিসহ ৬৫ টি আচরণবিধি মানার শর্তে কক্সবাজার পৌরসভা কেন্দ্রিক পর্যটন কেন্দ্রগুলো খুলে দেয়া হয়।

কিন্তু হোটেল-মোটেলসহ পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে প্রশাসনের এসব বিধি-নিষেধ যথাযথভাবে না মানায় পর্যটকদের আনাগোনা সংশ্লিষ্ট এলাকায় ব্যাপক হারে করোনা সংক্রমণের আশংকা তৈরী হয়েছে।

কক্সবাজার করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধ ও কন্ট্রাক ট্রেসিং কমিটির দেয়া তথ্য মতে, বিনোদন কেন্দ্রগুলো খুলে দেয়ার আগে গত ১৭ আগস্ট পর্যন্ত কক্সবাজারের হোটেল-মোটেলসহ পর্যটন সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের মধ্যে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৭ জন। কিন্তু গত ১৭ আগস্ট থেকে ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে ৬৮ জন।

এছাড়াও গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রোহিঙ্গারা বাদে কক্সবাজারে মোট করোনা আক্রান্ত হয়েছে ২১০ জন। এদের মধ্যে হোটেল-মোটেলের কর্মচারী ১২ জন, এনজিও কর্মি ৯২ জন ও জেলার স্থানীয় বাসিন্দা ৬২ জন। অন্যরা স্বাস্থ্যকর্মি ও আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরাসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের চাকুরিজীবি।

তবে আক্রান্ত এনজিও কর্মিদের অধিকাংশেরই বসবাস পর্যটন সংশ্লিষ্ট এলাকার বিভিন্ন আবাসিক হোটেলে হওয়ার কারণে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি উদ্বেগজনক বলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কক্সবাজারে পর্যটকদের আনাগোনা বৃদ্ধির পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধিসহ প্রশাসনের নির্দেশনা না মানার কারণে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি তৈরী হয়েছে। এ নিয়ে দ্রুত যথার্থ ব্যবস্থা নেয়া না হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

শনিবার কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত ও হোটেল-মোটেল জোন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সৈকতের লাবণী পয়েন্টের প্রবেশ পথে টাঙ্গানো সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে ‘ মাস্ক ছাড়া বিচে প্রবেশ নিষেধ’ । কিন্তু সৈকতে ঘুরতে আসা লোকজনের কেউ কেউ মাস্ক পরিধান করলেও অধিকাংশেরই ছিল না। মানা হচ্ছে না শারীরিক দূরুত্বের বিধি-নিষেধও। এছাড়া সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টের প্রবেশ পথগুলোতেও ব্যবস্থা নেই হাত ধোয়া আর হ্যান্ড স্যানিটাইজের।

শুধু তা-ই নয়, পর্যটকদের আবাসন হোটেল-মোটেলগুলোতে দেখা গেছে একই ধরণের অবস্থা। অভিজাত হোটেলগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মানা ও জীবানুমুক্তকরণের কিছুটা ব্যবস্থা থাকলেও অন্যান্যগুলোর অধিকাংশেরই তা নেই। এসব হোটেলে অবস্থানকারি পর্যটকদের মাস্কবিহীন ও শারীরিক দূরুত্ব না মেনে চলাচল করতেও দেখা গেছে।

এছাড়া স্বাস্থ্যবিধিসহ নির্দেশনা অমান্যকারিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনের কোন ধরণের তৎপরতাও চোখে পড়েনি।

সমুদ্র সৈকতে ঘুরতে আসা ঢাকার ধামরাইয়ের বাসিন্দা আহসানুল করিম বলেন, পর্যটকদের মধ্যে যারা সচেতন তারা স্বাস্থ্যবিধিসহ প্রশাসনের নির্দেশনা মানচ্ছেন। কিন্তু যারা সচেতন না তারাই মূলত: অমান্য করছেন।

চট্টগ্রাম থেকে বেড়াতে আসা সুমন চক্রবর্তী বলেন, মাস্কবিহীন অনেককে সৈকতে ঘুরতে দেখে তিনিও মাস্ক পরার তাগিদ অনুভব করেননি। তাছাড়া এটি নিয়ে সংশ্লিষ্ট কাউকেও তাগাদা দিতে তার চোখে পড়েনি।

সায়মা জান্নাত নামের এক নারী পর্যটক বলেন, সচেতনতার জায়গা থেকে নিজেই মাস্ক পড়ে এবং শারীরিক দূরুত্ব বজায় রেখে পরিবারের সঙ্গে ঘুরতে এসেছেন। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি ও প্রশাসনের নির্দেশনা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টদের আরো কড়াকড়ি আরোপ করা দরকার ছিল।

এ ব্যাপারে ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার অঞ্চলের পরির্দশক পিন্টু কুমার রায় বলেন, পর্যটকদের নিরাপত্তার পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মানতে প্রচারণাসহ সচেতনতা সৃষ্টিতে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে যারা যারা মাস্ক পরিধান করছেন না তাদের তাগাদা দেয়া হচ্ছে। সৈকতসহ পর্যটন এলাকাগুলোতে শারীরিক দূরুত্ব বজায় রেখে চলাচলেরও পরামর্শ দিচ্ছে পুলিশ।

তবে এসব ক্ষেত্রে ব্যক্তি সচেতনতা জরুরী বলে মন্তব্য করেন এ পুলিশ কর্মকর্তা।

এ নিয়ে কক্সবাজার করোনা প্রতিরোধ ও কন্ট্রাক ট্রেসিং কমিটির স্বেচ্ছাসেবক টিমের প্রধান সমন্বয়ক মো. নজিবুল ইসলাম বলেন, করোনা মহামারিকালে অন্যান্য শিল্পের চাইতে পর্যটন শিল্প অনেক বেশী ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ এ শিল্পে মানুষকে আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকতে হয়।

“ যেহেতু করোনা ভাইরাসটি মানবদেহ বহনের মাধ্যমে সংক্রমণ ঘটে, তাই পর্যটন শিল্প খুলে দেয়াটা প্রতিরোধের জন্য চ্যালেঞ্জের বিষয়। মানুষের আনাগোনার মধ্য দিয়ে করোনা সসংক্রমণ বৃদ্ধির একটি সম্ভাবনা থেকে যায়। ”

মহামারিকালের এ স্বেচ্ছাসেবক বলেন, “ বিষয়টি কন্ট্রাক ট্রেসিং কমিটি পর্যবেক্ষণ করছে। কিভাবে সংক্রমণের প্যারামিটারটি উঠানামা করছে সেটি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সংশ্লিষ্টদের করণীয় নির্ধারণে পরামর্শ দেয়া হবে। ”

স্বাস্থ্যবিধিসহ প্রশাসনিক নির্দেশনা মানার শর্তে পর্যটন শিল্প খুলে দেয়া হলেও বাস্তব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কেউ তা মানছে বলে মন্তব্য করে কক্সবাজার করোনা প্রতিরোধ ও কন্ট্রাক ট্রেসিং কমিটির সদস্য সচিব ডা. অনুপম বড়ুয়া।

অনুপম বলেন, ঘুরতে আসা পর্যটকদের অধিকাংশই মাস্ক ও গ্লাভস পরিধানসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছেন না। আবার কেউ কেউ তা ব্যবহার করলেও যত্রতত্র ফেলছেন এসব সংক্রমিত বর্জ্য ফেলছেন। সাধারণ বর্জ্যরে সাথে মিশে একটা ভয়ানক অবস্থার তৈরী হয়েছে।

“ এতে প্রতিদিন হোটেল কর্মচারীদের মধ্যে সংক্রমণ বাড়ছে। হোটেল-মোটেল জোনে কন্ট্রাক ট্রেসিংয়ের মাধ্যমে সংক্রমণ কমিয়ে আনার চেষ্টা করছিলাম। পর্যটন কেন্দ্রগুলো খুলে দেয়ায় কক্সবাজারবাসীর জন্য নতুন করে আবারো ঝুঁকি তৈরী হয়েছে। ”

স্বাস্থ্যবিধিসহ প্রশাসনের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব না হলে করোনা সংক্রমণের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন বিশেষজ্ঞ এ চিকিৎসক।